পেশা হিসেবে ফ্রিল্যান্সিংঃ কি, কেন এবং কিভাবে?

বর্তমানে পেশা হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং আমাদের দেশে তরুণদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফ্রিল্যান্সিং আজ অনলাইনে আয়ের অন্যতম মাধ্যম। যদিও এটি আমাদের দেশে এখনও নতুন, তবুও অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে তাদের ভাগ্য পুরোপুরি পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছেন। আমাদের দেশে এখন অনেকে আছেন যারা পড়াশুনার পাশাপাশি বা পড়াশুনা শেষে ফ্রিল্যান্সিং করে প্রতিমাসে ভালো পরিমাণ আয় করছেন।


পেশা হিসেবে ফ্রিল্যান্সিংঃ

ফ্রিল্যান্সিং হল একটি স্বাধীন পেশা যা গতানুগতিক চাকরির চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা প্রদান করে। এক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছামত কাজ করা যায়। 

pesha-hisebe-freelancing-ki-keno-kivabe


ফ্রিল্যান্সিং একটি বিশাল বাজার। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো খরচ কমাতে অনলাইনে মাধ্যমে তাদের কাজ আউটসোর্সিং করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশও এখন বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। দেশে এখন লক্ষ লক্ষ তরুন ফ্রিল্যান্সিংকে  ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহন করে অনলাইনে আয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক  রেমিটেন্স নিয়ে আসছে। আমরা যদি ফ্রিল্যান্সিং এর বিশাল বাজারের একটি ছোট অংশকেও কাজে লাগাতে পারি তবে এটি আমাদের দেশে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ার হাতিয়ার হতে পারে।


ফ্রিল্যান্সিং কি?

ফ্রিল্যান্সিং কে বলা হয় একটি মুক্ত পেশা। কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে না থেকে স্বাধীনভাবে কোন জব করাকে ফ্রিল্যান্সিং বলে। আর যারা ফ্রিল্যান্সিং জব করে তাদেরকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সার।  ফ্রিল্যান্সাররা ঘরে বসে কাজ করার  মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এটি একটি স্মার্ট পেশা যার মাধ্যমে যে কোন অফিসিয়াল চাকরির চাইতে ঘরে বসেই বেশি ইনকাম করা সম্ভব। মূলত স্বাধীনতা থাকে বলে মুক্ত পেশা হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং অনেক জনপ্রিয় একটি পেশা। 


ফ্রিল্যান্সিং কিভাবে করব?

১। ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে সবার আগে আপনার প্রয়োজন ইন্টারনেট কানেকশনসহ একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ। 

২। কোন একটি বিষয়ে আপনার কাজ করার দক্ষতা (Skill) থাকতে হবে। আপনি যে কাজটি ভালোভাবে পারেন, সেটি দিয়ে শুরু করতে পারেন। যদি কোন বিষয়ে দক্ষতা না থাকে তবে আপনাকে আপনার ভালো লাগে এমন একটি সেক্টর পছন্দ করে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে। যে বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে এবং যে কাজ আপনি সহজে শিখতে পারবেন বলে মনে করেন, সেই কাজ ভালোভাবে শিখে নিতে হবে। কাজ শেখার জন্য আপনার ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় ব্যয় করার মানসিকতা থাকতে হবে। 

হয়তোবা ভাবছেন শেখার জন্য আপনার ১ বছর সময় ব্যয় করা সম্ভব নয়। তাহলে আমি বলব, ফ্রিল্যান্সিং আপনার  জন্য নয়। আপনি অন্য কোন কাজ করার চেষ্টা করুন। মুক্ত পেশায় আসতে হলে প্রছুর ধৈর্য্য ও সাধনা প্রয়োজন। 

৩। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসের জন্য নিজেকে উপযোগি করে তোলা। আপনি হয়তো ১ বছর সময় ব্যয় করে কাজ শিখলেন। তারপর বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। নতুবা আপনার জন্য টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।

নিয়মিত অনুশীলন ও সময়ের সাথে আপ-টু-ডেট থাকতে হবে। ডেমো প্রজেক্ট চালিয়ে যেতে পারলে ভালো, এতে নিজের পোর্টফোলিও তৈরি সহজ হবে। নিজের পোর্টফোলিও মার্কেটপ্লেসগুলোতে ভালো এমাউন্টের বায়ারদের কাজ পাওয়াকে সহজ করে তোলে। 

৪। ফ্রিল্যান্সিং কাজে সফলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালোমানের কমিউনিকেশন স্কিল। যার ইংরেজিতে কমিউনিকেশন স্কিল যত বেশি তার কাজ পাওয়ার সম্ভবনা তত বেশি। এজন্য কাজ শেখার পাশাপাশি নিজের ইংরেজি শেখাটাও পাকাপোক্ত করতে হবে।  


ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য কি কি থাকা দরকার সংক্ষেপে তুলে ধরা হলঃ

  • প্রচুর ধৈর্য থাকতে হবে। 
  • কমপক্ষে একটি কাজে ভালো ধরনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
  • কাজের প্রতি অনেক আগ্রহ থাকতে হবে।
  • আয়ের উদ্দেশ্যে কাজ না শিখে দক্ষ হওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে।
  • ইংরেজী দক্ষতা অর্জন করতে হবে। 
  • কমিউনেকশন স্কিল ভালো হতে হবে।


ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসঃ 

ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য অনলাইনে হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা বায়াররা তাদের কাজ করানোর জন্য ফ্রিল্যান্সারদের হায়ার করে থাকে। আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী আপনার পছন্দের ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে হবে। কারন জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেসে বেশি ক্লায়েন্ট থাকে বিধায় অধিক পরিমানে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জনপ্রিয় কয়েকটি  ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে নিচে তুলে ধরা হলো।


১। আপওয়ার্ক (Upwork)

ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস Upwork

বিশ্বের জনপ্রিয় একটি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস হচ্ছে আপওয়ার্ক। শুরুতে এটি ওডেস্ক নামে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালে এটি আরেকটি জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস ‘ইল্যান্স’ আপওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে আপওয়ার্ক নামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আপওয়ার্কে ফিক্সড জব এবং আওয়ারলি জব দুই ধরণের কাজই পাওয়া যায়। পেমেন্ট মেথড হিসেবে আপওয়ার্কে রয়েছে পেপাল, পেওনিয়ার এবং লোকাল ব্যাংক ট্র্যান্সফার সুবিধা। 


২। ফাইভার (Fiverr)

ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস Fiverr

বিশ্বের আর একটি জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস হচ্ছে ফাইভার। ফাইভারে কাজ শুরু হয় ৫ ডলার থেকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ফ্রিল্যান্সাররা ফাইভারে কাজ করে। একজন নতুন ফ্রিল্যান্সার প্রতিদিন ১০ টি করে বায়ার রিকুয়েস্ট পাঠানোর মাধ্যমে কাজ পেতে পারে। এখানে ওয়েব ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, লোগো ডিজাইন, ভয়েস রেকর্ড, আর্টিকেল রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সোশ্যাল মার্কেটিং সহ আরো বিভিন্ন ধরনের কাজ পাওয়া যায়। পেমেন্ট মেথড হিসেবে ফাইভারে রয়েছে পেপাল, পেওনিয়ার এবং ব্যাংক ট্র্যান্সফার সুবিধা। তবে বাংলাদেশি লোকাল ব্যাংক এদের পেমেন্ট মেথডে নাই।


৩। ফ্রিল্যান্সার ডটকম (Freelancer.Com)

ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস Freelancer.Com

ফ্রিল্যান্সার ডটকম হচ্ছে আর একটি জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস, যেখানে ফিক্সড প্রাইস এবং আওয়ারলি রেটের কাজ পাওয়া যায়।এখানেও ওয়েব ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, লোগো ডিজাইন, ভয়েস রেকর্ড, আর্টিকেল রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সোশ্যাল মার্কেটিং সহ আরো বিভিন্ন ধরনের কাজ পাওয়া যায়। ফ্রিল্যান্সার ডটকমে প্রচুর পরিমানে জব পাওয়া যায়।  পেমেন্ট মেথড হিসেবে ফ্রিল্যান্সার ডটকমে আছে পেপাল, স্ক্রিল এবং লোকাল ব্যাংক ট্র্যান্সফার সুবিধা।


৪। গুরু (Guru)

ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস Guru

বিশ্বের প্রায় ৩০ লক্ষ এর অধিক লোক এই গুরুতে কাজ করে। ওয়েব ডিজাইন ও  ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, লোগো ডিজাইন, ভয়েস রেকর্ড, আর্টিকেল রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সোশ্যাল মার্কেটিং সহ আরো বিভিন্ন ধরনের কাজ পাওয়া যায়। আপওয়ার্কে মতো গুরুতেও ফিক্সড জব এবং আওয়ারলি জব দুই ধরণের কাজই পাওয়া যায়। পেমেন্ট মেথড হিসেবে এখানে রয়েছে পেপাল, পেওনিয়ার এবং লোকাল ব্যাংক ট্র্যান্সফার সুবিধা। 


৫। অন্যান্য ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস

উপরিউক্ত মার্কেটপ্লেসগুলো ছাড়াও পিপলপারআওয়ার, কেওয়ার্ক, এসইও ক্লার্ক, টপটল গোল্যান্স ইত্যাদি অনেক জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং সাইট।বর্তমানে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ ফ্রিল্যান্সার এই মার্কেটপ্লেসগুলোতে কাজ করছে। যাদের পেমেন্ট মেথড হিসেবে রয়েছে পেপাল, পেওনিয়ার এবং লোকাল ব্যাংক ট্র্যান্সফার সুবিধা। মার্কেটপ্লেসে কাজের ক্ষেত্রে অর্ডারের ২০% সার্ভিস ফি দিতে হয়। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস ছাড়াও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম থেকে ক্লায়েন্ট খুজে বের করে মার্কেটপ্লেসের বাহিরে থেকেও কাজ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ভালো বাজেটে কাজ পাওয়া যায়, কিন্তু পেমেন্ট সংক্রান্ত বিষয়ে জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। 


ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসগুলোতে কিভাবে কাজ পাওয়া যায়?

প্রায় সব ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে কাজ করার জন্য প্রথমে আপনার একটি একাউন্ট  বা প্রোফাইল তৈরি করে ভালোভাবে সাজিয়ে নিতে হবে। কি কি কাজে আপনার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে, আপনার এডুডেকশন কোয়ালিফিকেশন কি, আপনার ব্যক্তিগত জেনুইন তথ্য ও ছবি দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল তৈরি করতে হবে। এবং আপনার পূর্বের কাজের পোর্টফোলিও সুন্দর ভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। 


অনেক মার্কেটপ্লেসে আপনার সার্ভিসগুলো সুন্দরভাবে প্রাইসসহ তুলে ধরতে হবে। যেখানে বায়ার বা ক্লায়েন্টরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্ডার করে থাকে। আবার বায়াররা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী জব পোস্ট করে থাকে, যেগুলোতে আপ্লিকেশান করার মাধ্যমে কাজ পাওয়া যায়। ক্লায়েন্ট অর্ডার করার সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ পেমেন্ট মার্কেটপ্লেসে জমা দেন। কাজ সম্পন্ন করে ডেলিভারি দেয়ার পর কিছু দিনের মধ্যে মার্কেটপ্লেস সেই পেমেন্টর ক্লিয়ারেন্স প্রদান করে থাকে। তারপর সে অর্থ উত্তোলনযোগ্য হয়। এভাবে মার্কেটপ্লেস  গুলো থেকে কাজ করে নিজের পছন্দমত পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে সেই অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আনা যায়।


মূল কথা হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং কাজ করার জন্য আপনার যেকোন একটি কাজের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনার যদি কোন বিষয়ে দক্ষতা না থাকে, তাহলে আপনি কোন প্রতিষ্ঠান হতে সেই বিষয়ে কোর্স করে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যেমন- ওয়েব ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, সার্স ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশান, ভিডিও এডিটিং এবং কনটেন্ট রাইটিং ইত্যাদি বিষয়ে কোর্স  করে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে টাকা আয় করতে পারবেন।


সবার জন্য ফ্রিল্যান্সিং কোর্স করার প্রয়োজন নেই। ইউটিউব বা বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে আপনি নিজে নিজে শেখার মাধ্যমে কোন কাজে দক্ষতা অর্জন করে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে পারেন।


আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং এর সমস্যা এবং সম্ভাবনা।

ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে আমাদের নিবন্ধটি সম্পর্কে আপনার কোন পরামর্শ থাকে বা কোন ধরনের প্রশ্ন থাকে, তবে আপনি আমাদের কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন। এবং নিবন্ধটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে অবশ্যই ফেসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শেয়ার করে দিতে ভুলবেন না। সাজিদ আইটি (Sazid IT) ব্লগের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Previous Post Next Post